আবার যখনই দেখা হবে - নির্মলেন্দু গুণ


আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ 'ভালোবাসি'।
এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে
দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।

এরকম উন্মোচনে যদি তুমি আনুরাগে মুর্ছা যেতে চাও
মূর্ছা যাবে,জাগাবো না,নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।

'ভালোবাসি' বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।

বউ - নির্মলেন্দু গুণ


কে কবে বলেছে হবে না? হবে,বউ থেকে হবে ।
একদি আমিও বলেছিঃ 'ওসবে হবে না ।'
বাজে কথা । আজ বলি,হবে,বউ থেকে হবে ।
বউ থেকে হয় মানুষের পুনর্জন্ম,মাটি,লোহা,
সোনার কবিতা, ---কী সে নয়?

গোলাপ,শেফালি,যুঁই,ভোরের আকাশে প্রজাপতি,
ভালোবাসা,ভাগ্য,ভাড়াবাড়ি ইতিপূর্বে এভাবে মিশেনি ।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল,দুইজন্ম এবার মিশেছে,দেখা যাক ।

হতচ্ছাড়া ব্যর্থ প্রেম,গাঁজা,মদ,নৈঃসঙ্গ আমার
ভালোবেসে হে তরুণ,তোমাকে দিলাম,তুমি নাও ।
যদি কোনদিন বড় কবি হও,আমার সাফল্য
কতদূর একদিন তুমি তা বুঝিবে ।

আমি কতো ভালোবাসা দু'পায়ে মাড়িয়ে অবশেষে,
কল্পনার মেঘলোক ছেড়ে পৌঁছেছি বাস্তব মেঘে ।
আজ রাত বৃষ্টি হবে মানুষের চিরকাম্য দাবির ভিতরে ।

তার শয্যাপাশে আমার হয়েছে স্থান, মুখোমুখি,
অনায়াসে আমি তা বলি না, বলে যারা জানে দূর থেকে ।
আমি কাছে থেকে জানি, বিনিময়ে আমাকে হয়েছে দিতে
জীবনের নানা মূল্যে কেনা বিশ্বখানি, তার হাতে তুলে ।
অনায়াসে আমিও পারিনি । ক্রমে ক্রমে, বিভিন্ন কিস্তিতে
আমি তা দিয়েছি, ফুলে ফুলে ভালোবেসে যেভাবে প্রেমিক ।

প্রথমে আত্মার দ্যুতি, তারপর তাকে ঘিরে মুগ্ধ আনাগোনা ।
স্বর্গের সাজানো বাগানে পদস্পর্শে জ্বলে গেছি দূরে, তারপর
পেয়েছি বিশ্রাম । আজ রাত সম্পর্কের ভিতরে এসেছি ।

সবাই মিলবে এসে মৌন-মিহি শিল্পে অতঃপর,
তোমার প্রদত্ত দানে পূর্ণ হবে পৃথিবী আমার ।

স্বপ্ন, নব-ভৌগোলিক শিখা - নির্মলেন্দু গুণ


এখন আমার বয়স কত হবে? একশ? নব্বই? আশি?
হায়রে আমার বেশি-বয়সের স্বপ্ন, আমার একশ হবে না ।
আমি ময়মনসিংহের কবি, নীরার একান্ত বাধ্য স্বামী,
আমার বয়স পঁয়ত্রিশ, আমি ঢাকায় এসেছি স্বরচিত
কবিতা পড়তে । আমার বড় ভাই পশ্চিম বাংলার,
আমি স্বদেশের মায়ায় জড়ানো কবি ।

আয়াতুল্লা খোমিনির মতো আমার মাথার চুলে ব্রহ্মজীবী
শুভ্র-কাশদল, ফাল্গুনের হাওয়ায় মাতাল শাল-গজারীর
সবুজ পাতার ঝিলিমিলি আমার দু'চোখে ।
আমার দু'হাতে ধর্ম, দাঙ্গা,
আর প্রলম্বিত সামরিক শাসনের কালো শৃঙ্খলের দাগ ।
পায়ে এঁটেল মাটির মায়া, বুকে প্রিয়-নিধনের ক্ষত ।
আমি মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ, আমি জন্মযোদ্ধা ।
আমি যুদ্ধে-যুদ্ধে, বিপ্লবে-বিপ্লবে...,আমার পেছনে দগ্ধ
ইতিহাসের ট্রাজিক উল্লাস; তবু জানি আমার সম্মুখে আছে
পৃথিবী কাঁপানো স্বপ্ন, আছে নব-ভৌগোলিক শিখা ।

আমার বয়স যখন বাড়বে, তখন প্রতিটি সূর্যোদয়ে
সূর্যমুখীর মতন একটি-একটি ক'রে পাপড়ি মেলবে
আমার প্রতিটি কবিতার ভিতর-বেলার বর্ণ ।

আজ যে আঙুরগুলো আমি মাটির ভিতরে পুঁতে রেখে যাচ্ছি,
একদিন তার নেশায় মাতাল হবে ভবিষ্যতের বাংলা আমার ।
তখন আমার বয়স কত হবে?

একটি খোলা কবিতা - নির্মলেন্দু গুণ


আসুন আমরা আগুন সম্পর্কে বৃথা বাক্য
ব্যয় না করে একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি
জ্বালিয়ে দিয়ে বলিঃ 'এই হচ্ছে প্রকৃত আগুন ।
মীটসেফ খোলা রেখে, বিড়ালকে উপদেশ দিয়ে
অযথা সময় নষ্ট ক'রে লাভ নেই, আসুন
আমরা মীটসেফের দরোজাটা বন্ধ করে দেই ।'

পুঁজিবাদী শোষণের পথ খোলা রেখে
সম্ভব নয় প্রকৃত মুক্তির স্বপ্ন দেখানো ।
ফুঁটো চৌবাচ্চায় জল থাকবার কথা নয়,
সে বেরিয়ে যাবেই; ওটাই জলের ধর্ম ।
আমাদের ধর্ম ভিন্ন হলেও টাকার ধর্ম একই ।

বুদ্ধিমান কৃষক তাই আগাছা উপড়ে ফেলে সময়মত,
নইলে তার কষ্ট-কর্ষিত জমিতে কি ফলতো ফসল?
পরগাছার আক্রমণ থেকে ফলবান বৃক্ষকে
রক্ষা করতে হয় পরগাছার গোড়া কেটে দিয়ে ।
রক্তচোষা জোঁকের মুখে দিতে হয় থুথু, অথবা চুন,
প্রচন্ড আঘাত ছাড়া
পৃথিবীতে কবে কোন দেয়ার ভেঙেছে?
পরশ্রমভোগী ধনিক শ্রেণীর সর্বনাশ ছাড়া দরিদ্রের
পুষ্টিসাধনের সংকল্প হচ্ছে চমৎকার অলীক কল্পনা ।

সুফল লাভ কি সম্ভব সুকর্ম ব্যতিরেকে?
কিংবা শস্য ভূমিকর্ষণ ছাড়া?
হাতুড়ে বৈদ্য গাংরিন সারাতে চান
ক্ষতস্থানে পুরনো ঘি মালিশ করে,
শিক্ষিত ডাক্তার পরামর্শ দেন অপারেশনের ।
তাতে কিছু রক্তপাত হয় বটে,
হয়তো কেটে ফেলতে হয় কোন প্রিয় অঙ্গ--
কিন্তু ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য ওটা এমন কিছু নয় ।
এর কোনো সহজ বিকল্প নেই । এটাই নিয়ম ।

কথার ফুলঝুড়িতে চিড়ে ভিজানোর ব্যর্থ চেষ্টায়
সময় নষ্ট না করে আসুন আমরা জলের কথাই বলি ।